১৯৮৭ সালের কোন এক মঙ্গলবার। একজন ভদ্রলোক প্রথমবারের মতন বাবা হতে যাচ্ছেন। তাঁর মনে একই সাথে আনন্দ ও উৎকন্ঠা। নির্দিষ্ট সময়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে ভূমিষ্ঠ হলো তার প্রথম পুত্র সন্তান। কোথায় তিনি আনন্দিত হবেন, অথচ সেই সুযোগ তাঁর হলো না। তারঁ স্ত্রী সুস্থ্ আছেন,সমস্যা হলো তাঁর সদ্যভূমিষ্ঠ ছেলেটিকে নিয়ে। বাসার পাশেই এক চিকিৎসক বললেন- নবজাতকের অবস্থা সংকটাপন্ন, দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। বাবা ছুটলেন তার ছেলেকে নিয়ে পিজি হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানালেন- এই শিশুর লাইফ সাপোর্ট লাগবে,নয়তো বাঁচানো যাবে না।
সে যাত্রা অবশ্য শিশুটি বেঁচে গেলেও,যতই বড় হতে থাকে সেই ছেল শিশুটি কিছুতেই হাঁটছিলো না। জানা গেলো,সে “ওয়ের্ডনিগ হফম্যান ডিজিজ” নামে স্নায়ুর এক রোগে আক্রান্ত,সেই সাথে তার শরীরের মাংসপেশীর গঠনও একদম ঠিকভাবে হচ্ছিলো না। ভদ্রলোককে অনেক আত্মীয়-স্বজন বললেন,”এই ছেলেকে দিয়ে কি হবে,বড় হয়ে শুধু বোঝা বাড়বে। এর চেয়ে কোন এতিম খানায় রেখে আসুন,মাসে মাসে টাকা দিবেন।“ ভদ্রলোক এক হুঙ্কারে তাদের থামিয়ে দিলেন,”আমার ছেলে একদিন আপনাদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে ইনশাল্লাহ,দেখে নিবেন।“
অবশেষে স্রষ্টার অসীম অনুগ্রহে আর বাবা-মার ভালোবাসা নিয়ে ছেলেটি তিন বছর বয়সে হাঁটা শুরু করে। যদিও হাঁটতে গিয়ে কিছুটা সমস্যা কিন্তু তার থেকেই যায়। সেই বাবা তার ছেলেকে সবসময় বলতেন,”কেউ তোর হাঁটার সমস্যা নিয়ে হাসাহাসি করলে মন খারাপ করবি না। মনে রাখবি,মানুষের আসল জোর হলো মনের জোর। “ বাবার সেই কথাগুলো মাথায় ঢুকিয়ে প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে স্কুলে যেত ছেলেটি। অনেক সময়ই পায়ের জন্মগত সমস্যার জন্য ব্যালেন্স হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তো রাস্তায়। তারপর বাবার কথাগুলো মনে করে আবার উঠে দাঁড়াতো। এভাবে ছেলেটি স্কুল-কলেজ পার হয়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
বাবা সব সময় বলতেন তার ছেলেকে,” বাপ রে, একটা কথা মাথায় রাখবি- কোনদিন কারো উপকার করতে না পারিস,ক্ষতি করিস না। যতটুকু সম্ভব দেশের জন্য ভাল কিছু করতে চেষ্টা করবি।“ নিজের বাসায় এক লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন সেই ভদ্রলোক। নিজের জীবনে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। হয়তো অনেক উঁচুতে নয়,কিন্তু সম্মানজনক একটা অবস্থানে অবশ্যই। তাঁর মতে, এই পথ চলাতে একমাত্র অনুপ্রেরণা ছিল বই। সেই ভদ্রলোক কি জানেন যে নিজের অজান্তেই বই পড়ার নেশাটুকু তিনি তার ছেলের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন?
এই হলেন আমার বাবা। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে একটি টাকাও ঘুষ না খেয়ে নিজ অফিসে এক উদাহরণ তৈরি করেছেন। অনেকের দৃষ্টিতে বাবা হয়তো সম্পদহীন। কিন্তু সততা আর নিজের সন্তানদের ভেতর অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা আর ভাল কাজের প্রতি সম্মানবোধ তৈরি করে দিতে পেরেছেন। আর শিখিয়েছেন,বিপদে কিভাবে ধৈর্য ধারণ করতে হয়।
আজো আমরা সব ভাই-বোন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি,কিন্তু বাবা এখনো আমাদের এমনভাবে স্নেহ করেন যেন আমরা সেই ছোট্টটি রয়ে গিয়েছি। যখন জীবনযুদ্ধে নানা সমস্যায় মন বলে হেরে যাব,তখন শান্ত-সৌম্য এই চেহারার মানুষটির চেহারা মনে ভেসে ওঠে। মন বলে-”না কিছুতেই হেরে যাওয়া চলবে না।“
বাবা গতবার পবিত্র হজ্ব পালন করে এসেছেন। সেখানকার একটা ঘটনা আজো আমাকে নাড়া দেয়। বাবাদের হজ্ব কাফেলার সদস্যরা মক্কায় যে বাড়িতে ছিলেন,তার মালিক ছিল এক পাকিস্তানী নাগরিক। সে বাবাদের কাছে ভাড়া নিত কড়ায় করায় গণ্ডায়, যদিও পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহের ঠিক ছিল না মোটেই। এটা নিয়ে বাবা ও অন্যরা অভিযোগ জানালে ঐ লোক বলে,”আমি তোমাদের চেয়ে দৈহিকভাবে শক্তিশালী,তোমরা কি করতে পারবে শুনি?” আর আমার আব্বু নাকি তখন শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিলেন,”আমরা কি করতে পারি সেটা তোমার দাদা-পরদাদা ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা খানকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো...” বলাই বাহুল্য যে সেই এক কথাতেই সমস্যা সমাধান হয়ে গেল।
বাবা, কখনো তোমাকে বলা হয় নি যে,তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসি। হয়তো তুমি খুব সাধারণ একজন ছা-পোষা মানুষ,কিন্তু তুমি কি জানো তোমার মতো সাধারণ হতে হলেও অনেক “অসাধারণ” হতে হয়?
Tidak ada komentar: বাবা দিবস: তৃতীয় বিজয়ী লেখা- "একজন নিতান্তই সাধারণ বাবার গল্প"
Posting Komentar