১)
একটু বড় হওয়ার পর থেকেই আমার অপ্রিয় মানুষদের তালিকায় বাবা এক নাম্বারে না হলেও তিন-চারে ঠিকই বসে থাকতেন। ছোটবেলায়ও যে বাবাকে খুব পছন্দ করতাম-তা না। শৈশবে বাবাকে কাছে পাওয়া হয়নি খুব একটা। বাবার চাকরী ছিল কুমিল্লায়। আমি থাকতাম মায়ের সাথে; নানুবাড়ি। মনে আছে ছুটিতে বাবা আসবে শুনলেই অস্বস্তি শুরু হত। "বাবা" খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা ছিলেন না আমার জীবনে। বাবা মানেই হঠাৎ সতেরো ঘরের নামতা বলা, অথবা ভাত খাচ্ছি- একদলা শাক আমার প্লেটে তুলে দিয়ে কটমট করে তাকানো। না পারতাম খেতে, না পারতাম উঠে যেতে। মাঝে মাঝে কান্না চলে আসতো। কিন্তু কাঁদা যাবে না। আবিষ্কার করলাম কান্না চেপে রাখলে গলা ভার হয়ে যায়। সেই গলা দিয়ে শাক-ভাত নামার প্রশ্নই ওঠে না। অপেক্ষা করতাম বাবার খাওয়া শেষ হওয়ার। অথবা বিকেলে খেলতে যাব- বাবার হুঙ্কার, 'সারাটাদিন টইটই টইটই। একেবারে চামড়া তুলে ফেলব। বই নিয়ে বস।'
'চামড়া তুলে ফেলব' কথাটা বাবার খুব পছন্দের ছিল।
ছোটবেলা থেকেই বাবা এক অন্য মানুষ। আদরহীন, রুক্ষ, রোবটগোত্রের কেউ যার কিনা দু দু'টি চোখ থাকা স্বত্তেও একচোখা। ছোটবোন পিঠাপিঠি হওয়ায় প্রায়ই মারামারি লেগে যেতো। রিঙ্কির শেষ আশ্রয় ছিল বাবা। যত দোষই থাকুক বাবার কাছে সে ধোয়া তুলসি পাতা। যেন জগতের সব দোষ নিয়ে জন্মেছিলাম আমি। তপ্ত চোখে বাবা দাঁত কিড়মিড় করতেন। 'চামড়াটা এক্কেবারে তুলে ফেলব।' দাঁতে দাঁত ঘষাটা তার বকাবকির একটা অংশ ছিল। দেখলে মনে হবে এখনি বুঝি দুই-একটা দাঁত খুলে আসবে। কিন্তু বাবার দাঁত যথেষ্ঠ মজবুত ছিল। কত কত দিন বকা খেয়ে বাথরুমের ট্যাপ ছেড়ে কেঁদেছি তার ইয়ত্তা নেই। মনে হত কেউ আমাকে পছন্দ করে না। কেউ চায় না। আস্তে আস্তে বাবা দূরের মানুষ হতে থাকেন। 'দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকুন'- এটা আসলে একটা বিজ্ঞাপনই।
বাবা একবার আমার ঘরে আসলেন। অস্বস্তি। খাটে বসলেন। লক্ষন সুবিধার না। 'বাবা' সামথিং ইজ রং। ভেরী রং। বাবার মুখ থেকে 'বাবা' শুনলেই বুঝতে হবে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে বা হবে। 'কত মানুষইতো ঈদ ঢাকায় করে। এবার আমরাও করি। কি বলিস?' বাবা থামেন। আমি কিছুটা অবাক কিছুটা হতাশ চোখে তার দিকে তাকাই। 'ঈদের পরই তো ফাইনাল পরীক্ষা। এখন বাড়ি যেয়ে কাজ নেই। পড়াশুনা কর।' কথাগুলো আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঈদে নানুবাড়ি যাওয়া হবে না? অনেক কষ্টে চোখের পানি চোখেই আটকে রাখি। বাবা উঠে দাঁড়ালেন। 'বেঁচে থাকলে অনেক ঈদ আসবে।' ঈদের সালামি-নানুর সাথে নামাজে যাওয়া-সিফাত, রাহাদের সাথে দুষ্টামী- আর ভাবতে পারি না। চিবুক বেয়ে নামে নোনাপানি চিকন পথ ধরে। সবকিছুর জন্য এই মানুষটা দায়ী। এই বাবাটা। রাগে-দুঃখে হেঁচকির মত উঠতে লাগল।
কখনো কখনো কানে আসত বাবা-মার কথা কাটাকাটির শব্দ। মনে মনে আমি মায়ের পক্ষে থাকতাম সবসময়। আর আদালতে সাজা পেতেন বাবা। ইচ্ছে করত মাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই; যেখানে বাবা, দাঁত কিড়মিড়ানো, চামড়া নিয়ে টানাটানি,ঝগড়াঝাটি কিছুই নেই। বাবার অনুপস্থিতির জগৎটা কেমন শান্তি শান্তি হবে তা ভেবেই পুলকিত বোধ করতাম।
সময় বয়ে যায় তর তর করে। শ্রাবনের দুরন্ত পাহাড়ী নদী যেন। বিরামহীন,একটানা আর একঘেয়ে। আর বাবাও বসে থাকলেন না। ধীর পদক্ষেপে হয়ে গেলেন আরো দূরের কেউ। যাকে চিনি কিন্তু পরিচয় নেই, তেমন একজন। তার সাথে কথাবার্তা হয় না তেমন। নিদেনপক্ষে সামনেই যাই না; অস্বস্তিভরে এড়িয়ে চলি। এড়িয়ে চলি না বলে শামুকের মত। খোলের মাঝে লুকিয়ে থাকি বলা যায়। হঠাৎ সামনে পড়ে গেলেও চোখে চোখ পড়ে না ভুলেও। কোন দরকার হলে মাকে দিয়ে বলাই।
মা মাঝে মাঝে বিরক্ত হন, 'তোর টাকা লাগবে- তোর বাবাকে বল। আমাকে বলে কি লাভ?'
'তুমি তারে বল।'
'তুই বলতে পারিস না?'
'না। দিলে দাও না দিলে নাই।'
দিন কেটে কেটে যেতে থাকে। মাঝে মাঝে দিনগুলো দ্রুতই যায়।
২)
ঝির ঝির করে চিকন ধারায় বৃষ্টি ঝরে। বৃষ্টি থামি থামি করেও থামার নাম বা গন্ধ কিছুই নিচ্ছে না। মাথার রুমালটা ভিজে চপচপ। বৃষ্টির হালকা ফোঁটায় চশমার কাঁচ ঝাপসা- যেন কেউ চশমার কাচটা শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে দিয়েছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকি। চোখ ঝাপসা, চশমার কাঁচ ঝাপসা- তাই সামনে একটা অস্পষ্ট সাদা মূর্তির মত দেখি। খাটিয়ায় শোয়ানো। অনেকটা লম্বা-সাদা কোলবালিশের মত। নানুর বাড়িতে এমন একটা কোলবালিশ ছিল। যদিও সেটা সাদা ছিল না। কি রঙের ছিল তা স্মরন নেই।
জয়নাল কাকা কানের কাছে তার পানখাওয়া মুখ নিয়ে আসেন। জর্দামাখা গরম বাতাস কানে ঝাপ্টা দেয়। কাকা ফিস ফিস করেন। 'বাবা, এইবার ভাইজানকে নামায়া দাও।'
'বাবা' শব্দটা হঠাৎ করে কানে লাগে। গলার নিচ থেকে কেমন জানি শূন্যতা অনুভব হয়। ধারনা হয় পাঁজরের হাড়ের নিচে কিছু নেই। হৃদপিন্ড, ফুসফুস-কিচ্ছু না। একটা কষ্ট যেন শূন্য বুক থেকে উপরে উঠতে গিয়ে গলায় এসে আটকে গেছে। ঢোক গিলতে কষ্ট হয়; ছোটবেলার মত। আমার মনে হয় আমি হাফপ্যান্ট পড়ে বসে আছি নানুবাড়ির খাওয়ার টেবিলে। বাবা সামনে বসে আছেন। আমার প্লেটে একগাদা শাক-ভাত। বাবার খাওয়া শেষ। কিন্তু উঠছেন না। আজ আমাকে আজ শাক-ভাত না খাইয়ে উঠবেন না।
৩)
তখন আমি বেশ ছোট। ছুটিতে বাড়ি আসলে বাবা কিছু কড়কড়ে নতুন দুই টাকার নোট দিতেন। পাঁচটা বা ছয়টা। 'নোটগুলা যত্ন করে প্যান্টের পকেটে রেখে দে। এরা বাচ্চা দিবে।'
'সত্যি?' কিছুটা অবিশ্বাসী অনেকখানি উত্তেজিত গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম।
বাবা হ্যাঁ-সূচক হাসি হাসেন।
ভয়ে ভয়ে টাকাগুলো হাফপ্যান্টের পেছনের পকেটে রাখতাম; সাবধানে। একটু পরপরই গুনতাম। কিসের বাচ্চা কিসের কি? যা ছিল তাই আছে। বাবাকে বললে অপেক্ষা করতে বলতেন। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই প্যান্টের পকেটে হাত দিতাম। আসলেই দু'টাকার নোট বাচ্চা দিয়েছে। একটা বা দু'টা নোট বেশি।
সবাইকে টাকার জন্মবৃত্তান্ত বলে বেড়াতাম। বাবা হাসতেন। একসময় বাবা চলে যেতেন। নোটগুলো আর বাচ্চা দিত না। আমি প্রতিটাদিন গুনতাম। তারা ততদিনে বন্ধ্যা হয়ে গেছে।
মুখের ভেতরটা তেতো লাগে। বাতাসের অক্সিজেন যেন বেশ খানিকটা ভারী ঠেকে।
নিঃশ্বাসগুলো পালিয়ে যেতে চায়।
বুদ্ধি হবার পর বাবাকে একবারই কাঁদতে দেখেছিলাম। সেদিন আমার রেজাল্ট দিয়েছিল। এসএসসির। বাবাও আমার সাথে স্কুলে গিয়েছিলেন। আমিতো ভয়েই শেষ, নার্ভাসিত হয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছি। রেজাল্ট খারাপ না। এ-প্লাস। রেজাল্ট জানার পর বাসায় আসা পর্যন্ত রিকশায় বাবা একহাত দিয়ে শক্ত করে আমাকে ধরে রেখেছিলেন আর অন্যহাতের রুমাল দিয়ে একটু পর পর চোখ মুছছিলেন। আমি অস্বস্তি নিয়ে সারাপথ চুপ করে ছিলাম। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছিল।
৪)
'বাবা, আর দেরী করা ঠিক হবে না।'
আমি আস্তে করে পা বাড়াই। পা বাড়াই খাটিয়ার দিকে। যার উপর বাবা অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা করছেন আমাকে নিস্তার দিতে। যিনি আর কখনো দাঁতে দাঁত ঘষবেন না, চোখ রাঙ্গাবেন না, বলবেন না চামড়া তুলে ফেলার কথাও। আর কখনো......বাবার ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকতে হবে না, ঘরে এখন ইচ্ছেমত চলাফেরা
করা যাবে।......
হাত-পায়ে যেন কোন বোধ নেই। নড়তে চায় না। দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষন কষ্ট হয়। ইচ্ছে করে মাটিতে বসে পড়ি; চিৎকার করে বৃষ্টি ঝরাই। নাহলে কষ্টগুলো নিজেরাই বেরিয়ে পড়বে হয়তবা; একজন আমৃত্যু দূরের কারো জন্য।
বৃষ্টি বড় বড় ফোঁটায় পড়তে শুরু করে। দূরের মানুষটাকে আরো দূরে ঠেলে দিতে গিয়ে মনে হয় আসলে কিছু মানুষ এতই কাছে থাকে যে তাদের দূরের মানুষ বলে ভুল হয়। এরা থাকে নিজের থেকেও কাছে। 'বাবা...' ধরা গলায় এটুকুই বলতে পারলাম। আরো কিছু হয়ত বলার ছিল। গলার জালে আটকে যায় বাকীটা। কেইবা শুনবে??
Tidak ada komentar: বাবা দিবস: দ্বিতীয় বিজয়ী লেখা- " দূরে থাকা ও অচেনা নিকটবর্তী "
Posting Komentar