প্রকৃত অর্থে ভালবাসার কোন মৌসুম নেই, কোন নির্দিষ্ট দিন-মাস নেই। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার জন্য ভালবাসা আটকে থাকে না। ভালবাসার অনুভব কারো মনে সঞ্চারিত হতে পারে যে কোন সময়। তবুও এই ফেব্র“য়ারী মাসে ভালবাসা বিশেষ আবেদন নিয়ে আমাদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। কারণ, এই মাসেরই ১৪ তারিখ পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিক-প্রেমিকা, ভালবাসার সকল পূজারী পালন করে ভালবাসার দিন, ভ্যালেন্টাইনস ডে। এ মাসেই আমাদের দেশে ফাল্গুনের সূচনা, বসন্তের আবির্ভাব।
সর্বব্যাপী এই ভালবাসা কেবল প্রেমিক-প্রেমিকা বা কবি-সাহিত্যিকদেরই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু নয়, বিজ্ঞানী ও গবেষকদেরও এর প্রতি রয়েছে প্রবল আগ্রহ। তবে তাদের আগ্রহের কারণটা ভিন্ন এবং বলতে পারেন, নন-রোমান্টিকও। মানব-স্বাস্থ্যের উপর ভালবাসার প্রভাবই তাদের প্রধান ঔৎসুক্য। তাদের গবেষণালব্ধ ফল ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিদের জন্য উদ্দীপকই বটে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভালবাসা স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক। তবে, এখানে ভালবাসা বলতে আকর্ষণের প্রাথমিক উদ্দামতা, মোহগ্রস্ততা বা কেবলমাত্র নর-নারীর আদিম প্রেমকে বোঝানো হচ্ছে না। ভালবাসা বলতে অন্তরঙ্গ ও উপভোগ্য একটি স্থায়ী সম্পর্কের উপর জোর দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এর প্রেক্ষিতেই ভালবাসার ইতিবাচক প্রভাব বুঝতে গবেষণা করা হচ্ছে বিবাহিত ব্যক্তিদের উপর। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে, সুখী দম্পতিরা দীর্ঘায়ু হন; তাদের হার্ট অ্যাটাক এবং ক্যান্সার হওয়ার হারও অসুখী দম্পতি বা অবিবাহিতদের চেয়ে কম। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিবাহিত মহিলাদের হৃদরোগ, লিভার সিরোসিস ও আত্মহত্যাজনিত কারণে মৃত্যুর আশংকা একাকীদের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। অপরদিকে একাকী পুরুষদের এই আশংকা সুখী বিবাহিতদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশী।
নিঃস্বার্থ ভালবাসা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও-ভিত্তিক ‘ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ অন আনলিমিটেড লাভ’-এর গবেষক ইসথার এম স্টার্ণবার্গ বলেন, যে কোন ধরণের শারীরিক বা মানসিক চাপ শরীরে কর্টিসোল হরমোনের নিঃসরণ বাড়ায়। এই কর্টিসোল দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। ভালবাসা সেই চাপ কমাতে সাহায্য করে, ফলে কমে যায় কর্টিসোল নিঃসরণও। ওয়াশিংটনের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের গবেষকরাও ভালবাসার রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতার বিষয়টি সমর্থন করেন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাঃ ক্যানডেস পার্ট বলেন, স্থিতিশীল, দীর্ঘস্থায়ী ভালবাসার বন্ধন শরীরে ‘এনডরফিন’ নামক এক ধরণের রাসায়নিকের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ‘এনডরফিন’ আবার ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রাকৃতিক ঘাতক কোষের পরিমাণ বাড়ায়।
প্রগাঢ় ভালবাসা বার্ধক্য বিলম্বিত করে, যৌবনের স্থায়ীত্ব বাড়ায়। ক্যালিফোর্ণিয়া-ভিত্তিক ‘হার্টম্যাথ ইনস্টিটিউট’ স্বেচ্ছায় ভালবাসা অনুভবের এক অনুশীলন উদ্ভাবন করে এবং গবেষণায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের সেই অনুশীলনটি করায়। নিয়মিত অনুশীলনের ছয় মাসের মাথায় বার্ধক্য-রোধী হরমোন হিসেবে পরিচিত ‘ডিহাইড্রোএপিএন্ড্রোস্টেরন’ বা ডিএইচইএ হরমোনটি তাদের দেহে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায় এবং নয় মাসের মাথায় তা ৯০ শতাংশ বাড়ে।
হৃদ-স্বাস্থ্যের উপরও ভালবাসার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। দশ হাজার বিবাহিত পুরুষের উপর এক গবেষণা চালান আমেরিকান গবেষকরা। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিসের মতো হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে জীবনযাপন করছিলেন তারা। ফলে, হৃদরোগের কারণে বুকে তীব্র ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি ছিল সকলেরই। এদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। প্রথম দলে ছিলেন সেসব পুরুষ, যারা স্ত্রীর সত্যিকারের ভালবাসায় সিক্ত। অন্যদিকে যারা মনে করতেন স্ত্রীরা তাদের ভালবাসে না, তারা ছিলেন দ্বিতীয় দলে। পরবর্তীতে দেখা গেছে, দ্বিতীয় দলের পুরুষদের মাঝে ঐ ধরণের তীব্র বুকে ব্যথা হওয়ার হার ছিল প্রথমোক্ত দলের প্রায় দ্বিগুণ।
২০০৭ সালে ‘হিউম্যান কমিউনিকেশন রিসার্চ’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ভালবাসার অনুভূতি কেবল কাগজে লেখার মাধ্যমেই কমানো যায় হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কোলেস্টেরল! পাঁচ সপ্তাহব্যাপী গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতিদিন তিনবার ২০ মিনিট করে তাদের ভালবাসার মানুষটিকে উদ্দেশ্য করে মনের অভিব্যক্তি লিখতে বলা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, তাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য হারে।
এমনকি, কেবল ভালবাসা-জড়ানো নিবিড় আলিঙ্গনও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনায় পরিচালিত এক গবেষণায় অংশ নেয়া যুগলরা প্রথমে পাশাপাশি বসে গল্প করেন, এরপর গভীর ভালবাসায় জড়িয়ে ধরেন একে অপরকে। পরবর্তীতে দেখা যায়, মহিলাদের ক্ষেত্রে কর্টিসোল হরমোন এবং রক্তচাপ দুই-ই হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে নারী-পুরুষ উভয়েরই শরীরে ‘বন্ধনের হরমোন’ বলে পরিচিত অক্সিটোসিনের নিঃসরণ বেড়েছে। ‘সাইকোসোমাটিক মেডিসিন’ জার্নালে এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
শারীরিক বেদনা উপশমেও ভালবাসার ভূমিকা রয়েছে। এমআরআই পরীক্ষায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের যে অংশ ব্যথার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, সুখী দম্পতিদের সেই অংশ অধিক কার্যকরী হয়ে থাকে। প্রায় সোয়া লাখ ব্যক্তির উপর পরিচালিত এক জরীপে দেখা যায়, বিবাহিত ব্যক্তিদের মাথাব্যথা, কোমর ব্যথা জাতীয় উপসর্গ অবিবাহিতদের চেয়ে কম হয়। প্রকৃত ভালবাসা জীবনকে সুখময় করে, মানসিক চাপ মোকাবেলা সহজ করে, উদ্বেগ ও বিষণœতা কমায়, কমায় মাদকাসক্তির আশংকাও।
ভালবাসার যে স্বাস্থ্যকর একটা দিক আছে, তা জেনে হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকারা আনন্দিতই হচ্ছেন। কিন্তু যাদের প্রেম করার মতো কেউ নেই, তাদেরও, অন্তত এ ক্ষেত্রে, দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। ভালবাসার স্বাস্থ্যকর উপকারিতা লাভের জন্য একজন প্রেমিক বা প্রেমিকা থাকাটা বাধ্যতামূলক নয়। ভালবাসা হতে পারে বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান বা সহপাঠী-সহকর্মীর প্রতিও। এমনকি পোষা জীবটির প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসাও আপনাকে দিতে পারে স্বাস্থ্যগত সুবিধাটুকু। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে, বড় কোন রোগ বা অস্ত্রোপচারের পর যারা কোন প্রাণী পোষেন, তারা অন্যদের চেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তাই, ভালবাসুন। ভালবাসুন আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীকে, আপনার আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনকে, ভালবাসুন মানুষ এবং সৃষ্টির সকল জীবকে। ভালবাসুন - এবং - সুস্থ থাকুন।
Tidak ada komentar: স্বাস্থ্যকর ভালবাসা !
Posting Komentar