নতুন শিশুটিকে নিয়ে বাড়ি জুড়ে উৎসব। দাদী-ফুফুদের কোলে কোলে ঘোরে সিফাতের প্রথম সন্তান। নানী-খালারাও প্রায় প্রতিদিনই ছুটে আসছে যাত্রাবাড়ি থেকে মিরপুরে। সিফাতের স্বামী শামিমেরও সন্তানকে ঘিরে কতো আয়োজন। কিন্তু এই উৎসবের আমেজের ভেতরেই কেমন যেন বিষাদ ঘিরে থাকে সিফাতকে। কেন থাকে? - তারও কোন উত্তর পায় না সে। প্রায়ই মন খারাপ লাগে, বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, লুকিয়ে কিছু সময় কেঁদে হালকা হতে চায়, তবু মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারে না অন্তর্গত অস্বস্তির কথা। এমনকি ভালবেসে বিয়ে করা শামিমকেও না। - কি মনে করবে ওরা?- এই ভাবনা কন্ঠ চেপে ধরে তার।
সিফাতের সমস্যাটা সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে কমে এলেও শান্তার সমস্যাটা রয়েই যায়। সন্তান জন্মের পর প্রথম এক মাস ভালই ছিল সে। তারপর, ধীরে ধীরে মন খারাপ ভাব বাড়তে থাকে তার। উদ্বেগ, অনিদ্রা , খাওয়ায় অরুচি - সব মিলে বিধ্বস্ত লাগে। তবুও সে বলতে পারে না কাউকে। কেউ তার পরিবর্তনটা লক্ষ্য করলেও হয়তো গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। অবশেষে সবার টনক নড়ে সেদিন, যেদিন অচেতন শান্তার বিছানার পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায় ঘুমের ওষুধের তিনটি খালি পাতা।
সন্তানের আগমন আনন্দের উপলক্ষ্য হলেও সদ্য মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া নারীদের মন খারাপের অনুভূতির ঘটনা মোটেও বিরল নয়। বরং, গবেষকরা বলেন, প্রসবের চার থেকে ছয় সপ্তাহের ভেতর প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রসূতি আবেগজনিত সমস্যার মুখোমুখি হন। নতুন মা অস্থিরতা বোধ করেন, অকারণেই মন খারাপ হয়ে যায়, বিহ্বলতা জাগে, সবকিছু যেন বিশৃংখল-এলোমেলো মনে হয়, কান্না পায় প্রায়শই, আবার হঠাৎ করেই খানিকটা সময়ের জন্য উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রসবের তিন থেকে পাঁচ দিনের ভেতরেই এসব লক্ষণ দেখা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রসব ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে নারীদেহে হরমোনের তারতম্য, প্রসবজনিত মানসিক চাপ, মাতৃত্বের দায়িত্ববোধের উপলব্ধি - সব মিলিয়েই নারীর এই বিশেষ মানসিক অবস্থাটির সৃষ্টি হতে পারে। স্বস্তির সংবাদ হচ্ছে, এর অধিকাংশই হয়ে থাকে ক্ষণস্থায়ী। কয়েক দিন থেকে সপ্তাহ পর্যন্ত এই লক্ষণগুলো স্থায়ী হতে পারে। প্রসব-পরবর্তী সাময়িক এই মানসিক অবস্থাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়- বেবী ব্লু। এ সময় নতুন মায়ের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত সমর্থন, সহমর্মিতা আর শিক্ষা। শিক্ষা - সন্তান প্রতিপালনের, শিক্ষা - দায়িত্বশীলতার, শিক্ষা - দৃঢ়তার সাথে মানসিক চাপ মোকাবেলার। পরিবারের, বিশেষ করে স্বামীর বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে এ সময় স্ত্রীর পাশে থাকার, তাকে সাহস যোগানোর। নতুন মায়েরও উচিত মনের এই দুঃখবোধ চাপা না রেখে স্বামী বা প্রিয় কারো সাথে তা শেয়ার করা, সহযোগিতা কামনা করা।
উপসর্গগুলো যদি থেকে যায় দু সপ্তাহের বেশী, তাহলে প্রয়োজন পড়তে পারে বিশেষজ্ঞ সহায়তার। নারী আক্রান্ত হতে পারেন "বিষণ্ণতা" নামের মানসিক অসুখে। গবেষকরা বলেন, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসূতি আক্রান্ত হন ‘পোস্ট-পারটাম ডিপ্রেশন’ বা প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতায়।
‘বেবী ব্লু’র মতো ক্ষণস্থায়ী হয় না এ রোগ, উপসর্গ গুলোও হয় তীব্রতর। প্রায় সার্বক্ষণিক মন খারাপ ভাব, হতাশা, অতিরিক্ত উদ্বেগ, অনিদ্রায় ভোগেন নতুন মা। দৈনন্দিন কাজকর্মে উৎসাহ হারান, মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না কোন কিছুতে। এমনকি নিজের শখের বা পছন্দের কাজগুলো করতেও আর ভাল লাগে না। অল্প পরিশ্রম বা বিনা পরিশ্রমেই ক্লান্তি বোধ করেন। খাদ্যাভ্যাসে আসে পরিবর্তন। বেশীরভাগেরই খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায়। স্বল্পাহার বা অনাহারে থাকার ফলে কিছুদিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে ওজন কমে যায়। কেউ কেউ আবার বেশী বেশী খেতে শুরু করেন। ফলে তাদের ওজন বেড়ে যেতে পারে অস্বাভাবিক হারে। অনেকেই অকারণে অপরাধবোধে ভোগেন, বিগত দিনের তুচ্ছ-প্রায় ঘটনাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ফলে নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করেন। সবার মাঝে থেকেও নারী একাকীত্বে ভোগেন, নিজেকে অসহায় লাগে, ধীরে ধীরে পরিবারের সকলের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে খোলসবন্দী হয়ে পড়েন। মারাত্মক ব্যাহত হয় সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিজীবন। নারী তার নিজের জীবন সম্পর্কেই এক সময় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, হয়ে ওঠেন আত্মহত্যাপ্রবণ।
প্রসবের ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে নারী আক্রান্ত হতে পারেন বিষণ্ণতায় । যাদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব ইতিহাস আছে অথবা যাদের পরিবারে কারো বিষণ্ণতায় আছে বা ছিল, তাদের ক্ষেত্রে প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশী। যথাযথ চিকিৎসা না নিলে মাস থেকে বছরব্যাপী এ রোগ স্থায়ী হতে পারে। এদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে গুরুতর বিষণ্ণতায় পুণরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিষণ্ণ নারী তার সন্তানের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। মায়ের বিষণœতার কারণে সন্তান বঞ্চিত হয় উপযুক্ত মাতৃস্নেহ ও সেবা থেকে। বিষণ্ণ নারী যেমন নিজের যত্ন নেন না, তেমনি সন্তানের যত্নেও উদাসীন থাকতে পারেন।
তাই সন্তান-জন্মের আনন্দ উৎসবের মাঝে লক্ষ্য রাখুন সদ্য মা হওয়া নারীটির মানসিক অবস্থার দিকেও। উপযুক্ত সমর্থন ও সহযোগিতা দিন নতুন মাকে। প্রয়োজনে ব্যবস্থা করুন বিশেষজ্ঞ সহায়তার।
Tidak ada komentar: নতুন মায়ের মন ভাল তো?
Posting Komentar