বাবা দিবস এলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। আমার মা- যার কখনো লেখক হবার স্বপ্ন ছিলো না, কখনো কেউ তাঁকে বলেনি 'তোর লেখার হাততো অনেক ভালোরে!'
মা বলেন তাঁর জীবনটাই এক উপন্যাস। যে উপন্যাসের অক্ষর,শব্দ,কথা,আদরের যতিচিহ্নগুলো থেকে গেলো আলোকবর্ষ দূরে। আমার সেই মা-ই একদিন টুকিটাকি সাংসারিক চিঠি লেখার অবসরে, আয়-ব্যয়ের প্রাচীন চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কি যত্নে লিখে ফেললেন এক পৃষ্ঠার স্মৃতিকথা। চোখে মুখে অনেকটা সংকোচ, অস্বস্তি আর দ্বিধার পাহাড় ছুঁয়ে আমার লেখার টেবিলের এক কোণে রেখে গেলেন সেই স্মৃতিকথা। আমি তখন ওয়েবসাইটে বাবা দিবসের রাশি রাশি ফিচার পড়ছি, গোপন ঈর্ষায় বলছি 'লেখার হাত কি ভালো!'
আমার মা কখনো লেখক ছিলেন না, অন্ততঃ আমি তাই মনে করতাম। হয়তো আমার মাও তাই মনে করেন, আর তাই কখনো জানতে চাননি যে বাবাকে নিয়ে লেখা সেই স্মৃতিকথা তাঁর লেখক মেয়ের কেমন লেগেছে।ব্যস্ত লেখক মেয়েও কোনদিন বলেনি জ্যৈষ্ঠ দিনের আচমকা সেই স্মৃতির ব্যাপারে অথবা লেখক মেয়ের অবহেলা কোথায় যেন সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে এক পৃষ্ঠার সেই স্মৃতিকথা। আমি খুঁজে পাইনি সেই পৃষ্ঠা আর কোনদিন। কোন এক অভিমানের মতো সে হারিয়ে গেছে সময়ের গভীরে, কিন্তু বাবাকে নিয়ে লেখা সেই স্মৃতিকথা আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যেখানে লেখক ব্যর্থ হয় হয়তো সেখানে কন্যা ঠিকই জিতে যায় সাপলুডু খেলায়। আমার জানতে ইচ্ছে করে- খুব অভিমানে সেই অক্ষরগুলো হারিয়ে কোথায় গেছে? হয়তো অন্য আলোতে থাকা সেই বাবার কাছে চলে গেছে, হয়তো সেই বাবা জলের ভারী চশমা চোখে পৃষ্ঠার অক্ষরগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছেন পরম আদরে...
বাবাকে নিয়ে আমার কোন স্মৃতি নেই, কিন্তু বুকের গভীরে কোথাও একটা স্মৃতিসৌধ আছে যার মুখোমুখি দাঁড়ালেই আমার বাবাকে মনে পড়ে। প্রাচীন ইতিহাসের দেয়ালে উঠে দাঁড়ায় এক জানালা। সেই জানালা কোনদিন আমাকে বাবার কাছে যেতে দেয়নি, কিন্তু স্পর্শ করতে দিয়েছে আমার বাবার আলোছায়াকে। বাবার কোন ছবি আমাদের কাছে নেই।
বাবা নাকি মাকে বলতো "হ্যাঁ, আমি যখন থাকবো না তখন আমার ছবি দেখে দেখে কাঁদো আর কি!"
বাবার ছবি দেখে কাঁদতে হয়নি আমাদের কিন্তু কান্না কি থেমে থাকে একটা ছবির জন্য? দেখতে পারার যেমন দুঃখ থাকে তেমনি না দেখতে পারারও তো এক ধরনের দুঃখবোধ থেকে যায়।
অনেক বছর পরে আমার মেয়ে সত্যজিত রায়ের 'ফেলুদা সমগ্র' থেকে একটা কথা আমাকে শুনিয়েছিল "যার যত বেশি ছবি তোলা হবে তার তত বেশি আয়ু কমে যাবে।" ওখানে কিসব ভাইটাল ফোর্সের স্থানান্তরের কথা ছিল। তার মানে হয়তো এই- আমার ‘আমি’ অন্যকিছুতে যত চলে যাবে তত আমি আমার নিজের অস্তিত্ব হারাবো। শুনে ভেবেছিলাম সত্যি যদি তাই হতো! এই ধারণা মতে আমার বাবারতো দীর্ঘকাল পৃথিবীর আলো দেখার কথা ছিল। হয়তো আমার বাবার ভাইটাল ফোর্স ছবির বদলে অন্য কোথাও, অন্য কোন স্মৃতিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল।
বাবার সাথে আমার জীবন কেটেছে তিন মাস আর বাবার স্মৃতির সাথে কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের ভরাডুবি। আর অবশ্যই এই সময়ের বার্ধক্য যেখানে আমি বাবার থেকেও বয়সে বড় হয়ে গেছি। বাবা স্বপ্নে দেখেছিলো তাঁর একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। স্বপ্ন দেখে খুব রাগ করলেন মায়ের উপর 'আমার এত সুন্দর মেয়ে হলো অথচ বউ একটা চিঠি লিখেও জানালো না! এবারো মেয়ে হওয়ায় জানায়নি?' বাবার রাগ আরো বাড়ে। তিন মাসের ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসার আগে স্বপ্নে দেখা মেয়ের জন্য কতকিছু কিনলেন। তখনো কমলালেবুর ন্যায় এই পৃথিবীটা জানেনি যে এটাই ছিল মেয়ের জন্য এক বাবার শেষ বাজার করা। আর কোনদিন কেনা হবে না মেয়ের জন্য শখের মাটির পুতুল, লালরঙ্গা সেলোয়ার কামিজ, কলাপাতা রঙের চুড়ি, বড়বেলার প্রথম শাড়ি...
বাবা বাড়ি এসে দেখে মেয়ে কোথায়! অন্তঃসত্ত্বা বউ উঠোন ঝাড়ে ব্যস্ত। নানীআম্মা বাজার-সদাই দেখেতো ক্ষেপে গেলেন 'সাপ-ই হয় না ব্যাঙ-ই হয় তার ঠিক নাই। মেয়ের জন্য দুনিয়ার বাজার করে নিয়া আসছে!" সাপ-ব্যাঙের রূপকথা ছাড়িয়ে ঠিক সে রাতেই আমি হলাম- বাবার স্বপ্নের মেয়ে। আমি যেন শুধু এই অপেক্ষাই করছিলাম বাবা কবে আসবে। শীতের রাতে বাবা আমাকে গোসল করাতে দিলেন না। নতুন তোয়ালেতে জড়িয়ে সারারাত বুকে নিয়ে কোরআন শরীফ পড়লেন। আমি বাবার বুক ছুঁয়ে ধর্ম পেলাম, পেলাম এক অচেনা ঈশ্বর যিনি লিখে রাখেন মানুষের পাওয়া আর না পাওয়ার কাহন।
এসব কথা আমার মনে থাকার নয়। আমি শুনেছি মায়ের কাছে, নানুর কাছে, আমার দাইমার কাছে। শুনতে শুনতে হারানো মানুষটাকে আমি নতুন করে দেখেছি, জেনেছি। এক সময় আমিই বাবার স্মৃতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিয়েছি। এখন আমি আমার বাবার গল্প করি, আমার সন্তানের কাছে। আমার দুর্লভ ত্রৈমাসিক স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবি- ছুটি কেমন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। পাওয়া কেমন এক নিমেষে অনেক না-পাওয়ার দিকে ছুটে যায়!
"চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে/ আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।” বাবা ফিরে যাবার আগে মাকে বলেছিল কিছুদিনের মধ্যেই তোমাদের আমার কাছে নিয়ে যাব। বাবার শেষ চিঠিতেও ছিল সেই নতুন ঘরের গল্প "তুমি সব গুছিয়ে রাখো। আমি নিতে আসবো।" বাবা,তুমিতো আর নিতে এলে না আমাদের। শেষ পর্যন্ত তোমার নতুন ঘর হলো ঠিকই কিন্তু সেই ঘরে তুমি থেকে গেলে একা। তুমি ছাড়া আমাদের জীবন শুকিয়ে গিয়েছিল যেমন শুকিয়ে গিয়েছিল আমাদের গ্রামের সেই নদী। আমাদের স্মৃতিতে থেকে গেল আজন্ম গ্রীষ্মের দহন।
ফিরে গিয়েই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ডাক্তাররা বলেছিল অপারেশন ভালো হয়েছে, কিন্তু আমাদের বাবা সুস্থ হয়ে আর ফিরে এলো না। মা সেই সময়টায় বাবার কাছে থাকতে পারেনি কেননা বাড়িতে নানীআম্মার বসন্ত, আমার অসুখ। কোন এক লেখক লিখেছিল “পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় অতি প্রিয় কাউকে জড়িয়ে ধরে থাকতে হয়।” আমার বাবার কি খুব ইচ্ছে করছিল প্রিয় কাউকে জড়িয়ে ধরে থাকার? বাড়িতে বাবাকে ফিরিয়ে আনার কোন ব্যবস্থা করতে না পারায় পরবাসেই বাবার শেষ সমাধি হলো। তাই আমাদের স্মৃতিতে কোন নিথর বাবা নেই- যে বাবা হাজার ডাকেও সাড়া দেয় না, বুকে তুলে নিতে পারে না আদরের খোকা-খুকীদের। খোকার স্মৃতিতে থেকে যায় বাবার গায়ে লেগে থাকে কান্তা সেন্টের ঘ্রাণ, বাবার ছড়া 'লেখাপড়া শিখবে হারুন/ দেখবে কত দেশ।" খুকীর স্মৃতিসৌধে থেকে যায় বাবার মুখে শোনা কোরআনের আয়াত- "এমরানের স্ত্রী যখন বললো হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত।"
বাবার মৃতদেহ আমি দেখিনি, বাবার কবরের মাটি কেমন হয় আমি জানিনা। বাবার কাছ থেকে আমার কোনদিন শোনা হয়নি রোদের গল্প, মেঘের গল্প। মা বলতেন তাঁর মেয়েরা বাবার আদর পায়নি। আমি সবাইকে শ্বশুর দেখে বিয়ে দেব। আমার বড় দুবোনের শ্বশুর ভাগ্য ভালো ছিল। কিন্তু আমার কপালটাই এরকম- বিয়ের মাত্র ক’মাস আগে তিনি মারা গেলেন। আমার কাউকে আর বাবা ডাকা হলো না। আমি আমার ছেলে মেয়ের জন্য ওদের দাদার কবরের মাটি নিয়ে আসি। দাদুর কবরের মাটি দাদুর আশীবার্দের মতো ওদের পাশে থাকে- এটা ওদের বিশ্বাস; আমারও বিশ্বাস। কিন্তু আমি আমার সন্তানের জন্য নানার কবরের মাটি আনতে পারি না, দিতে পারি না নানার আশীর্বাদের স্পর্শ।
অচেনা দূরের শহরে খুব কাছের মানুষের শেষ ঠিকানা কি আমার অদেখাই থেকে যাবে? কিন্তু স্বপ্নে বাবা আমার মুখোমুখি হয় ঠিক যেমন অনেক কাল আগে এক স্বপ্নে আমি বাবার মুখোমুখি হয়েছিলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে 'মা তুই কাঁদিস কেন? বাবা তোকে নাইওর নিতে আসব।' আহ্ বাবার স্পর্শ এত কোমল হয়! বাবার বুকে এত ছায়া থাকে! থাকে এত সমদ্রের জলহাওয়া! বাবাকে আমার কখনো দেখা হয়ে উঠে না; আমাদের মাঝখানে থেকে যায় সূক্ষ্ম এক দূরত্ব কিন্তু সেই দূরত্ব ছাড়িয়ে আসে বাবার ছায়া, স্পর্শ, সমুদ্রের গাঢ় বাতাস যার গভীরে প্রিয় বাবার গন্ধ। আমি বেদনার সমুদ্রে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকি বাবার সাথে নাইওর যাবার...
Tidak ada komentar: বাবা দিবস: প্রথম বিজয়ী লেখা- "এক পৃষ্ঠার সমুদ্র"
Posting Komentar