শেষ! এই শব্দটার মধ্যে একটা মায়া আছে। একটা কান্নাও আছে বোধহয়। শেষ বলে কি কিছু হয়? আবার অন্য ভাবে ভাবলে শেষ তো হয়ই। জন্ম শব্দের মধ্যেই তো তার অস্তিত্বহীনতার কথা বলা আছে! জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ মানে পূর্ণ ছেদ। এরপর আর কিছু নেই।
শেষ বললেই শূন্যতাবোধ জাগে। সব হারানোর বেদনাবোধ জাগে। এই শূন্যতা বা বেদনাবোধ মনকে ভারাক্রান্ত করতে পারে, কিন্তু মলিন করে না। অনেকটা বিরহের মতো। বেদনাবোধ যেখানে সকালের নরম আলোয় মাটিতে বিছিয়ে থাকা শিউলির মতো। এই শূন্যতাবোধকে আমরা এড়াতে চাই না, বরং জড়াতে চাই। ইচ্ছে করে, না মিলতে পারার তীব্র বেদনাবোধকে সঙ্গী করে রাখতে। তাই শেষ বললেও শেষ আর হয় না!
কিন্তু সত্যিই কি তাই? মানবজন্মের কথাই ধরা যাক। যিনি চলে গেলেন, তিনি এই পার্থিব জগত থেকে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু অজস্র ডালপালার মতো ছড়িয়ে রেখে গেছেন তাঁর সংসার, তাঁর বৃহত্জলগত। যাঁরা রয়ে গেলেন তাঁদের কাছে তিনি শেষ হবেন কীভাবে! এইখানেই তো তাঁর তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসার, অনাবিল হাসিতে ভরে ওঠা দিনগুলি-রাতগুলি, কত গোপন কান্নাকাটি! একজনের মৃত্যুতে কীভাবে শেষ হয়ে যায় এইসব! সবই তো ধরা আছে তাঁর উত্তরসূরিতে, তাঁর স্বজনে, তাঁর পারিপার্শ্বিকে!
সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তো তাই! যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সে যা-ই হোক, তার নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিটি সম্পর্কেই নানা Shades আছে, কত বাঁক আছে! সেই সম্পর্ক তো তার নিজের জোরেই বলীয়ান। সেই সম্পর্ক তখন অন্য কোনও সম্পর্কের থেকে ন্যূন নয়। দাম্পত্যের কথাই ধরা যাক! বিবাহ বিচ্ছেদ কোনওদিনই বিরল ঘটনা ছিল না। আমরা দেখেছি বিচ্ছেদ পরবর্তী জীবনে দুটি মানুষই প্রান্তিক হয়ে গেছেন, পরস্পরের প্রতি নিরাসক্ত। আমরা দেখেছি বিচ্ছেদ পরবর্তী জীবনে একে অপরের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে বেঁচে আছেন। আমরা দেখেছি বিচ্ছেদ পরবর্তী জীবনেও একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কোনও তার কোনওদিন ছিঁড়ে গিয়েছিল বোধহয়, সেকারণেই আলাদা থাকা মাত্র! সব রকমই তো হয়! কিন্তু এই বিচ্ছেদ মানেই কি সেই সম্পর্ক শেষ! বোধহয় না। যে মানুষটি এই সেইদিনও এই বারান্দায় বসে অন্যমনস্ক ভাবে ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল, বা যে মেয়েটির নিজের হাতে বোনা সোয়েটার আজও ঝুলছে আলনাতে তারা তো প্রবল ভাবেই একে অপরের মধ্যে আছে! কীভাবে শেষ হয়ে যায় সেই সম্পর্ক! শুধু পৃথক ঠিকানা কি শেষ করে দিতে পারে এতদিনের একসঙ্গে পথ চলার ইতিহাসকে!
তবুও শেষ হয়তো হয় আমাদের অনুভূতির। আমাদের রাগ, ক্রোধ, অভিমান― এসবই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। একদিন ঝরেও যায়। জীবনের যা কিছু অশুভ তাকে মনে রাখতে চাই না আমরা। সচেতনভাবেই তাকে আমরা আড়াল করি। ফিরে যেতে চাই আনন্দের ভুবনে। যেখানে ভালবাসা আছে, সেইখানে। কেননা আমরা জানি যেখানে ভালবাসা আছে, তার কোনও শেষ নেই। অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথ তো সেই কথাই বলে গিয়েছিলেন, ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে?/ আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে।/সাঙ্গ হলে মেঘের পালা, শুরু হবে বৃষ্টি ঢালা/বরফ জমা শেষ হলে নদী হয়ে গলবে!’
সুতরাং আমার অন্তত মনে হয় শেষ বলে কিছু নেই...
Tidak ada komentar: শেষ বলে কিছু নেই . . .
Posting Komentar