আমার তখন অনেক কম বয়স... পরীক্ষায় নকল করা কাকে বলে আমি ঠিকভাবে বুঝিই না... ঢাকা শহরের স্বনামধন্য একটি স্কুলে পড়ি... ঠিক যতটুকু মনে পড়ে আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি... বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। গনিত পরীক্ষা শুরু হয়েছে।আমার মনে আছে আমার কাছে এক্সট্রা সাদা পৃষ্ঠা ছিল কিছু। ভুল করেছিলাম এইটাই যে পরীক্ষার শুরুর পরও (পুরোটা সাদা) পৃষ্ঠাগুলো আমার কাছে রয়ে গিয়েছিলো। আর পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে আমি পরীক্ষার হলে বসেই তাতে ত্রিভুজ এঁকেছিলাম। আমাকে সাদা পৃষ্ঠাগুলো নিয়ে পরীক্ষার রুমে ঢুকতে কোন বাঁধা দেয়া হয়নি... পরীক্ষা শুরু হলো... আমি সাদা পৃষ্ঠাটায় রাফ হিসেবে একটা ত্রিভুজ আঁকলাম শুধু... এরপরই ঘটলো বিপত্তি।
একজন মেয়ে টিচারকে ডেকে বলে উঠলো, "মিস মিস... ও না নকল করছে!" সাথে সাথে এসে আমার খাতাটা আর পৃষ্ঠাটা কেড়ে নেয়া হলো... সাদা কাগজে আঁকা ত্রিভুজটা সহ... বলা হলো, "কোন সাহসে নকল করছো! ছিঃ! এতোটুকুন বয়সে এইসব কাজ করতে শিখে গেছো! চুরি করো...! তোমার পরীক্ষা দেবার কি দরকার। তোমার পড়াশুনা করে কি হবে? আমরা চোর তৈরি করছি?!........." ইত্যাদি ইত্যাদি... আমি তো হতবাক... আমি বারবার বলার চেষ্টা করছিলাম যে, "মিস... আমি নকল করিনি। নকল কিভাবে। আমি তো সাদা পৃষ্ঠা সাথে নিয়ে এসেছি। এই ত্রিভুজটা আমি পরীক্ষার মধ্যেই বসে এঁকেছি... " -"কই! আমি তো দেখিনি... তোমরা কেউ দেখেছো? প্রশ্নে তো এটাই এসেছে। শিওর তুমি নকল করছিলে। সাথে নিয়ে এসেছো।" আর কেউ কোন উত্তর দিলো না... -"মিস। বিশ্বাস করেন আমি রাফ হিসেবে এটা এঁকেছি।" -"তো খাতায় আঁকবে। আলাদা সাদা পৃষ্ঠা এনে এঁকেছো? নাহ। অবশ্যই তুমি নকল করেছিলে। ছিঃ! এতো ছোট বেলা থেকে এই হাল। এই তুমি আর লেখতে পারবে না।পরীক্ষা দিতে পারবে না এখন।" -"মিস আমি তো জানতাম না যে পরীক্ষার খাতা ছাড়া আর কিছুতে রাফ করা যাবে না। আপ্নারা তো বলেন নি।" -"নকল করো, আর মুখে মুখে তর্কও করো! কি সাহস!" আর আমাকে আর কিচ্ছু বলার সুযোগ দেয়া হলো না। কেউ আমাকে বুঝলো ও না... সবাই পরীক্ষা দিলো।
আমি বসে থাকলাম... ৪৫ নম্বরের উত্তর নিয়ে... মনের ভেতর কষ্ট নিয়ে... আমি কি করলাম! মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেলো... কি হলো বুঝতেই যেন পারলাম না... এরপর প্রিন্সিপ্যালের রুমের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। গার্জিয়ান কে ডাকা হয়েছে ফোন দিয়ে। আমি চুরি করেছি তাই... আমি নকল করেছি তাই... অথচ আমার কাছে দুনিয়াটা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে... থেকে থেকে কিছুক্ষণ পরপর কাঁদছিলাম নিঃশব্দে লুকিয়ে... লজ্জা হচ্ছিলো খুব... সবাই চলে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি। একটা মেয়ে তার মাকে যেতে যেতে আঙ্গুল তুলে দেখাল, "আম্মু ঐ মেয়েটা না আজকে পরীক্ষায় নকল করেছে..." তার মা আমাকে অবাক হয়ে দেখছিলেন যেন চিড়িয়াখানার চিড়িয়া দেখছেন...
বিষয়টা যে কেমন লজ্জার তাও বোঝার বয়স ছিল না হয়তো সেদিন... তাই তেমন বুঝিই নি... বস্তুত আমি বুঝিই নি আমি করেছি কি ভুল?! নাহয় একটু বোকা ধরনেরই ছিলাম... কিন্তু আমি যতদিন বাঁচবো ততদিন এবং মরার আগ পর্যন্ত জেনে যাবো যে আমি নকল করিনি... প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম এর সাথে আম্মু এলেন দেখা করতে। আমাকে বলা হলো, "তুমি নকল করছো। জানো তুমি কি করেছো? আমার তো মাথায়ই আসছে না এতো কম বয়সে কিভাবে... কোথা থেকে এসব শিখেছো?" -"আপা, আমি নকল করিনি!" -"আবার বলে মিথ্যা কথা! দেখো,কাউকে না বলে তার কোন জিনিস নেয়াকে আমরা কি বলি? চুরি? তুমি কি করেছো জানো? তুমি চুরি করেছো। নকল হলো একধরনের চুরি। স্বীকার করো।" -"আপা, আমি সত্যি বলছি আমি নকল করিনি।" (আমি তখন খুব কাঁদছিলাম... আম্মু পাশে... তাঁর মাথা হেট হয়ে গেছে তখন... আমার পায়ের তলায় মাটি সরে গেছে তখন। মাথা ঘুরাচ্ছে...) (প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম আম্মুকে )-"দেখেন, আপনার মেয়ে একে তো নকল করেছে, তার উপর মুখে মুখে তর্ক করছে... এসব কি শিখিয়েছেন? বলেন? আপ্নারা যদি এসব না শিখান তো ও এসব শিখবে কোথা থেকে?" -"আপা... আমি নকল করিনি... আমি নিজে পরীক্ষার হলে ঐটা রাফ করেছি।"
পরীক্ষার হলে ডিউটিরত ম্যাডামঃ "এই মেয়ে! তুমি ঐটা নকলই করেছো। রাফ না। রাফ কথাটা কোথা থেকে শিখলে?" -"আপা, আমি সত্যি নকল করিনি আপা..." এভাবে অনেকক্ষণ কথা চললো। এতো কম বয়সের পিচ্চির কোথায় কেউ বিশ্বাস করলো না। -"তুমি স্বীকার করো যে তুমি নকল করেছো। নাহলে তোমার পরীক্ষার যা নাম্বার পেয়েছো তা তো পাবেই না। ফেল করবে...। দেখো, এসব কাজ ভালো না... স্বীকার করো যে তুমি নকল করেছো। তর্ক করো না... " আম্মু বললেন,"দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাও। বলো আর কখনো এমন করবো না।" অনেক কষ্ট হল বলতে... কারণ আমি কাজটা করিই নি... মাফ চাইলাম। বললাম... আমি নকল করেছি... পৃথিবীতে এমন অপমানজনক কিছু আমার কাছে আর ছিল না সেইসময়টায়... অপমানজনক এই জন্য না যে আমাকে মাফ চাইতে হলো... অপমানজনক এই জন্য যে আমি যেই খারাপ কাজটা করিই নাই, যেই কাজটা কি, কিভাবে করে তা-ই জানিনা, সেই কাজটির জন্য আমাকে স্বীকার করে নিতে হলো চাপের মুখে যে- আমি নকলবাজ।
আমি চোর... আমি একজন শিক্ককের সন্তান... আমার মা-বাবা আমাকে এইসব শিক্ষা দিয়েছেন... এর চাইতে অপমানজনক আর কি হতে পারে আমার কাছে! জীবনের অনেকটা সময় কেটে গেছে... পরবর্তীতে আমার এই স্কুলের অনেক ভালো ভালো শিক্ষক-শিক্ষিকার ছত্রছায়ায় আমার স্কুলজীবন পেরিয়ে গিয়েছে... তাদের থেকে আমি অনেক ভালো কিছু শিখেছি... জেনেছি... কিন্তু আমার মনে একটা কথাই রয়ে গেছে, যারা উচ্চপদস্থ থাকেন নামি-দামি স্কুল-কলেজগুলোতে তারা অধিকাংশই শিক্ষার্থীদেরকে, তাদের অভিভাবকদের কে মানুষ ভাবেন না। বড় তো হয়েই যান... বিনয়টা, বোধশক্তিটা পিছে ফেলে আসেন... এভাবেই চলে স্কুলগুলো... এভাবেই আমরা নির্যাতিত হই মানসিকভাবে... এভাবেই বেড়ে উঠি... আমাদের কথা শোনা হয় না... আমাদের কে বুঝতে চেষ্টা করা হয় না... শুধু টাকা নাও... এতো এতো মুরগীর বাচ্চা ফার্মে ভর্তি করো... তারা সোনার ডিম দেবে... কাড়ি কাড়ি টাকা... যখন তখন বিভিন্ন প্রোগ্রামের নামে টাকা... টিউশনি পড়তে আসবে... আরও টাকা... ঠুসে ঠুসে বিদ্যা দাও... অবশেষে "তোতাকাহিনী"র মত- "পাখি মরিলো" অনেক আগের কথা... তখন আমার মা আমাকে বিশ্বাস করেন নি... এখন বললাম আজ... বলতে গিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারিনি... কেন জানি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম...
এখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একজন শিক্ষার্থী... "শিক্ষা" বিষয়টি নিয়ে অধ্যয়ন করছি... আমার মা আজ আমার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনলেন। আজ তিনি আমাকে বিশ্বাস করলেন... আমার অবস্থা বুঝলেন... আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আর অভিশাপ দিলেন ঐসব মানুষগুলোকে... আজ এতোদিন পর আমি বুঝাতে পারলাম কাউকে যে আমি চোর না... আমি চুরি করিনি... আমি নকল করিনি... বিনাদোষে শাস্তি মাথা পেতে মেনে নিয়েছি... হঠাৎ করে এই লেখাটি লেখার কারণ হলো, টি.ভি. তে নিউজে দেখলাম সাইকেলের পার্টস চুরি করেছে এমন অপবাদ দেয়ায়, অভিভাবক ডেকে আজেবাজে ব্যবহারে অপমান করায় সেইন্ট জোসেফ স্কুলের একজন শিক্ষার্থী ক্ষোভে-লজ্জায় আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিয়েছে... কেন? কেন এমন হবে? হুট করে না জেনে শুনে, না বুঝে একজন শিক্ষার্থীকে দোষ দিয়ে দেবন...? তাকে স্কুল থেকে টি.সি. দিয়ে বের করে দেবার ভয় দেখাবেন...? যা তা বলবেন...? শিক্ষার্থীরা মানবে....? গার্জিয়ানরাও মানবে...? তারা আপনাদের হাতের খেলার পুতুল????
সেইন্ট জোসেফ স্কুলের বদনাম করার জন্য লিখছি না... কিংবা, আমার স্কুল ভিকারুননিসার বদনাম করার জন্যও না... ক্ষোভ রয়ে যায় কিছু মানুষের অমানবিক আচরণের প্রতি... আমি দেখেছি অভিভাবকদের সাথে অনেক ক্ষেত্রে স্কুলের দারোয়ান থেকে প্রিন্সিপ্যালরা পর্যন্ত অনেকেই খুব বাজে আচরণ করেন যখন তারা সন্তানের কোন বিষয়ে কথা বলতে যান... তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন তারা...। অনেককেই ক্ষোভে বলতে শুনেছি,"এরা আমাদের মানুষ মনে করে না। কুকুর-বিড়ালের মত আচরণ করে। খুব খারাপ আচরণ... কেন যে এই স্কুলে ভর্তি করালাম!" খুবই অমানবিক আচরণ... মুখে বলতে খারাপ লাগে... অনেকটা কুকুর-বিড়াল তাড়ানোর মত অবস্থা... কেন???
কেন এরকম আচরণ হবে? শিশুদের সাথেও এমন আচরণ কেনই বা হবে? অনেক ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো লিখছি আজ... যে ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে সে আমার ছোট ভাইয়ের মত... ক্লাস ফোরে আমি হয়তো আত্মহত্যা কিভাবে করে, কি তাও বুঝতাম না বলে রেহাই পেয়েছি... কিন্তু এভাবে আর কত প্রাণ ঝরে যাবে?? যার যায় সেই বোঝে... খুব খারাপ লাগে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ গুলোর এমন চকচকে মুখোশ লাগানো জঘন্যতর অবস্থার কথা ভাবলে... স্কুলের উন্নয়নের জোয়ারে-সুনামে লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে আসে প্রতিবছর... বিত্তশালী অনেকেই আবার মোটা অঙ্কের ডোনেশন নিয়ে তৈরি থাকেন... যেকোনভাবে যদি ছেলেটারে বা মেয়েটারে "ঐ" স্কুলটায় ভর্তি করানো যায় একবার! তাইলে তো লাইফে আর চিন্তা নাই!!!! আসলে সব মাকাল ফল... সব মুখোশধারী... শিক্ষার নামে কলঙ্ক... মাঝ থেকে... যাঁতাকলে পিষি আমরা... এভাবেই বেড়ে উঠি... মনের ভেতর শ্রদ্ধাবোধ বলে আমার কিছু নেই এসব মানুষের প্রতি... ছিলও না... প্রতিবছর তাও আবারো লাখে-লাখে, ঝাঁকে-ঝাঁকে অভিভাবকরা দৌড়াবেন এসব স্কুলের ফর্ম কিনতে......
অনেক কষ্টে বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাদের শিশুদের ভর্তি করাবেন এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন... এরপর? "না পারি কইতে... না পারি সইতে..." অবস্থা... আরও অনেক অত্যাচার তো আছেই... আজ না হয় নাই লিখলাম...। এদের কিছু কিছু অমানবিক আচরণ তো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না... কিন্তু আর কত? আমি স্বেচ্ছাচারী এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন দেখতে চাই... পরিবর্তনে অংশ নিতে চাই...। কোমলমতি শিশুদের সাথে এই যে অমানবিক আচরণ হয়,মানসিক নির্যাতন হয়-তার বিরুদ্ধে আমি অবস্থান নিচ্ছি... "কেন খারাপ আচরণ করবেন অভিভাবকদের সাথে? শিক্ষার্থীদের সাথে? আপনার নিজের পরিবারেও এমন একটি বা দু'টি শিশু রয়েছে... হতে পারে আপনার সন্তান... আপনার নাতি-নাতনী... তারাও যাবে আজ বাদে কাল আর কোন স্কুলে পড়তে... কেমন লাগবে আপনার, যদি তাদের সাথে এমনটি ঘটে?"
প্রশ্ন রইলো ঐসব বিবেকহীন, কাণ্ড-জ্ঞানহীন অমার্জিত আচরনসম্পন্ন মানুষগুলোর কাছে... উত্তরগুলো পরিবর্তিত ভালো আচরণের সাথে সাথে পাবো আশা রাখি... পরিবর্তন আসবেই... আমরাই আনবো পরিবর্তন... আর একটি প্রাণও এভাবে ঝরে যেতে দেবো না... আমার তো মনে হয় শিশুদের থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে... সততা, সত্যবাদিতা,ভদ্রতা... অনেকক্ষেত্রেই বড়(ম্যাচিউরড মানুষ)দের ওপর বিশ্বাস করাকেই আমরা প্রাধান্য দিই... শিশুদের কে অগ্রাহ্য করি... শুনতে চাই না... বুঝতে চাই না... এখন তো মনে হয়... শিশুদেরকে বিশ্বাস করা যায়... কিন্তু বড়দের না... ঘৃণা করি আমি... ঘৃণা ঘৃণা ঘৃণা ঐসব বিবেকহীন মানুষদের প্রতি... শিক্ষক নামের কলঙ্ক যারা... ঘৃণা তাদের প্রতি আমার...
Tidak ada komentar: ঘৃণা ঘৃণা ঘৃণা ঐসব বিবেকহীন মানুষদের প্রতি
Posting Komentar