পুরুষ বিদ্বেষী নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের সাম্প্রতিক একটি লেখা হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে চরমভাবে আঘাত হেনেছে। লেখাটি নিয়ে ভারতে ইতিমধ্যে মহাপ্রলয় শুরু হয়েছে। লেখাটিতে যৌনবাদী এই লেখিকা এক জায়গায় বলেছেন, “এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি, মানুষ প্রজাতির মধ্যে পুরুষ নামক যে প্রাণীটি আছে, তার উরুসন্ধিতে দুই বা তিন ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের যে লিঙ্গটি ঝুলে থাকে, সেটি। সেটি যাদের আছে, তাদের গায়ে কোনো উপদ্রব চাপাতে হয় না!” এ শব্দাবলী ব্যবহার করে হিন্দু নারীদের চরমভাবে অসন্মান করেছেন এবং নারী ও পুরষকে বিপরীত মেরুর প্রতিযোগি হিসাবে উস্কানি দেয়ার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
তসলিমা নাসরিনের সেই লেখাটি আমার ব্লগের পাঠকদের জন্য নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো:
“সতীদাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু নারীবিরোধী অনেক প্রথাই বেশ বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে এই ভারতীয় উপমহাদেশে। এসব দূর করার কোনো উদ্যোগ তো নেওয়া হচ্ছেই না, বরং আরও ঘটা করে পালন করার ব্যবস্থা হচ্ছে, আরও জাঁকালো উৎসব হচ্ছে এসবের। কিছুদিন আগেই বাঙালি বিবাহিত হিন্দু মেয়েদের ‘সিঁদুর খেলা’ হলো। দুর্গা-প্রতিমা বিসর্জনের দিন পরস্পরের মাথায় মুখে গালে কপালে চিবুকে নাকে কানে সিঁদুর মাখামাখি চলল। এই উৎসবটা মূলত- ‘স্বামী দীর্ঘজীবী হোক, অনন্তকাল বেঁচে থাকুক, স্বামীর অসুখ-বিসুখ না হোক, দুর্ঘটনা না ঘটুক, স্বামী সুস্থ থাকুক, কস্মিনকালেও না মরুক, আমাদের যা-ইচ্ছে-তাই হোক, আমাদের সুস্থতা গোল্লায় যাক, আমাদের দীর্ঘজীবনের বারোটা বাজুক’ এর উৎসব। বিধবা আর অবিবাহিতদের জন্য সিঁদুর খেলা বারণ। বারণ, কারণ তাদের স্বামী নেই। মাথায় তাদের সিঁদুর ওঠেনি অথবা সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে।
দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিয়ে করার পর একজনের শরীরে শাঁখা সিঁদুর পলা লোহার উপদ্রব চাপানো হয়, আরেকজনের শরীর আক্ষরিক অর্থে রয়ে যায় ঠিক যেমন ছিল তেমন। কেউ কি এই প্রশ্নটি করে যে, যে কারণে বিবাহিত মেয়েরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে, সেই একই কারণে কেন বিবাহিত পুরুষেরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে না? অথবা যে কারণে বিবাহিত পুরুষেরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে না, সেই একই কারণে কেন বিবাহিত মেয়েরা ওসব পরা থেকে বিরত থাকছে না?
সাফ কথা হলো, পুরুষ বিশ্বাস করে এবং নারীকেও করতে বাধ্য করে যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি, মানুষ প্রজাতির মধ্যে পুরুষ নামক যে প্রাণীটি আছে, তার উরুসন্ধিতে দুই বা তিন ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের যে লিঙ্গটি ঝুলে থাকে, সেটি। সেটি যাদের আছে, তাদের গায়ে কোনো উপদ্রব চাপাতে হয় না! তাদের জীবন-সঙ্গী বা স্ত্রীটির সুস্থ থাকার জন্য, তার পরমায়ুর জন্য কোনো ব্রত পালন করতে হয় না, তার ধনদৌলত লাভের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করার কোনো আচার অনুষ্ঠান করতে হয় না, স্ত্রীর মঙ্গলকামনায় তাদের দিনভর উপোস করতে হয় না, সিঁদুর খেলতে হয় না, যেমন স্ত্রীদের খেলতে হয় স্বামীর মঙ্গলকামনায়! পুরুষেরা বরং বেশ জমিয়ে নারীকুলের পুংলিঙ্গ পুজো দূর থেকে উপভোগ করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যে যে পুজোটি চলে, সে পুংলিঙ্গ পুজো। পুরুষেরা সমাজের ঈশ্বর, সমাজের মহাশক্তিমান, মহাক্ষমতাবান, পুরুষেরা নারীর প্রভু, অভিভাবক, অধীশ্বর, নারীর কর্তা, দেবতা। পুরুষের আরও শক্তি, আরও ক্ষমতা, আরও প্রভাব, প্রতাপ এবং প্রাচুর্য বৃদ্ধির জন্য, পুরুষের দীর্ঘজীবন এবং অমরত্বের জন্য, নারীদের, দুর্বলদের, দুর্ভাগাদের, দলিতদের, র্যাতিত, নিপীড়িতদের উপোস করতে হয়, প্রার্থনা করতে হয় ভগবানের কাছে। পুরুষের মঙ্গলকামনায়, সুখকামনায়, স্বাস্থ্যকামনায় ভাইফোঁটা, শিবরাত্রি, রাখি, শ্রাবণ সোমবার কত কিছুই না সারা বছর পালন করছে নারীরা!
নারী শিক্ষিত হচ্ছে, এমন কী স্বনির্ভর হচ্ছে, স্বামীর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা অনেকের প্রায় নেই বললেই চলে, স্বামী ছাড়া চলবে না- এমন কোনো ব্যাপারই নেই, এমন নারীও পুরুষতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাগুলো দিব্যি মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে। কেউ প্রশ্ন করছে না, বিয়ের পর কেন নারীর পদবি পাল্টাতে হবে, কেন পুরুষের পদবি নয়? কেন নারীকে তার শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে হবে, কেন স্ত্রীর মতো পুরুষের কর্তব্য নয়, শ্বশুরবাড়িতে বাস করা আর শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা? পণের নিয়ম যদি পালন করতেই হয়, তবে শুধু স্ত্রী কেন স্বামীকে দেয়, স্বামী কেন স্ত্রীকে পণ দেয় না? যার আছে, তারই শুধু চাই চাই! গোটা সমাজ তাকেই ঢেলে দিচ্ছে, তাকেই ভরে দিচ্ছে, যার অনেক আছে। অত্যাচারীকে করছে আরও দ্বিগুণ অত্যাচারী। ছলে বলে কৌশলে মেয়েদের দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা, তার ওপর ধরে বেঁধে যোগ করা হয়েছে শারীরিক আর মানসিক পরনির্ভরতা। ভারতবর্ষের বেশ কিছু রাজ্যের বিবাহিত মেয়েরা ‘করভা চৌথ’ পালন করে। সূর্যোদয় থেকে চন্দ্রোদয় অবধি স্বামীর সুস্বাস্থ্যের জন্য উপোস। চাঁদ দেখবে তবে জলস্পর্শ করবে লক্ষ লক্ষ পতিব্রতা স্ত্রী। এটিও ওই পুংপুজো। এইসব আচার অনুষ্ঠানের একটিই সারকথা, সংসারে স্ত্রীর নয়, স্বামীর জীবনটি মূল্যবান। দরিদ্র-অশিক্ষিত-পরনির্ভর মেয়েরা নয়, পুরুষতান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠানগুলো বেশির ভাগই পালন করছে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়েরা। এই মেয়েরাই কিন্তু আজকাল ধর্ষণ এবং অন্যান্য নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে খুব সরব, কিন্তু সিঁদুর খেলা বা করভা চৌথ পালন করছে রীতিমতো উৎসব করে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, করভা চৌথ, সিঁদুর খেলা সবই পুরুষতন্ত্রের নারীবিরোধী উপসর্গ। এক সময় ধর্ষণকে অপরাধ ভাবা হতো না, ইদানীং ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে ধর্ষণকে ভয়াবহ অপরাধ বলে ভাবা হয়। যদি করভা চৌথ এর বিরুদ্ধে মিডিয়া মুখর হয়, মানুষ পথে নামতে থাকে, করভা চৌথকেও বড্ড অন্যায় কাজ বলে ভেবে নেবে বেশির ভাগ মানুষ।
নারীবিরোধী এসব অনুষ্ঠান নিয়ে আজকাল তুমুল বাণিজ্যও হচ্ছে। করভা চৌথের চোখ ধাঁধানো উৎসব এখন সিনেমায়, থিয়েটারে, টিভি সিরিয়ালে। বিজ্ঞাপনে পুরুষতান্ত্রিক আচারাদিতে অলঙ্কৃত লাস্যময়ী নারীদের ঝলমলে দৃশ্য। যে মেয়েরা দূর থেকে দেখে এসব, দুঃখ-দুর্দশার জীবন যাদের, তাদের ইচ্ছে হয় সাজগোজ করা ফর্সা ফর্সা সুখী সুখী মেয়েদের মতো উৎসব করতে। তারাও এক সময় বাণিজ্যের ফাঁদে পা দেয়, শাড়ি গয়না কেনার ফাঁদে। এমনিতেই এই সমাজ মেয়েদের পণ্য বলে ভাবে। পুংপুজোর আচারে অংশ নিয়ে মেয়েরা নিজেদের আরও বড় পণ্য করে তোলে। এসব করে যত বেশি পুরুষকে মূল্যবান করে মেয়েরা, ততবেশি নিজেদের মূল্যহীন করে। পুরুষতান্ত্রিক অসভ্যতাকে, অসাম্যকে, লিঙ্গবৈষম্যকে, নারীবিরোধিতাকে, নারীবিদ্বেষকে, নোংরামোকে কেবল সহনীয় নয়, আদরণীয় আর আকর্ষণীয় করার পাঁয়তারা চলছে চারদিকে। যেসব রাজ্যে করভা চৌথ পালন হতো না, এখন সেসব রাজ্যেও পালন হয়। পুরুষতন্ত্র বড্ড সংক্রামক। মানুষ সামনে এগোয়। সভ্য হয়। বৈষম্য ঘোচায়। সমাজ বদলায়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েরা যত শিক্ষিত হয়, যত নিজের পায়ে দাঁড়ায়, ততই যেন পিতৃতন্ত্রকে মাথায় তুলে নাচে, ততই ধর্মের ঢোল বাজায়। ওপরে ওপরে মনে হয় সমাজ বদলেছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হাজার বছরের পুরনো সমাজ তার পচা গলা শরীর নিয়ে অন্ধকারে ঠাঁই বসে আছে, তাকে নাড়ায় সাধ্য কার!
এই সমাজ নারীকে নানাভাবে উৎসাহিত করে পুরুষতন্ত্রের শিকার হতে। পুরুষের অধীনতা মেনে নিলে সমাজ নারীকে বাহবা দেয়। নিজের অধীনে নয়, নারী যেন কোনো না কোনো পুরুষের অধীনে থাকে। নারীর অধীনতাকে বা পরাধীনতাকে ‘নারীর গুণ’ হিসেবে ধরা হয়। গুণবতী নারী হওয়ার এই পুরস্কারটি যার জোটে, সমাজ তার ওপর খুব খুশি থাকে। সমাজকে খুশি করতে মেয়েরা যে করেই হোক চায়। কারণ একে অখুশি রেখে বা অসন্তুষ্ট রেখে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। হায়ারার্কি বা স্তরতন্ত্র কিন্তু গড়ে উঠেছে পেট্রিয়ার্কি বা পিতৃতন্ত্রের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই। স্তরতন্ত্রের মধ্যে থেকে বা স্তরতন্ত্রে বিশ্বাস করে, অধীনতা এবং আধিপত্যের অবসান ঘটানো, অথবা ক্ষমতার উঁচু নিচু স্তরকে ভেঙে সমান করে দেওয়া সম্ভব নয়। সমান করা সম্ভব করতে হলে স্তরতন্ত্রটাকেই আগে বাতিল করতে হয়। ঠিক একই রকম, নারী পুরুষের সমতাও পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তি না হলে কখনো সম্ভব নয়।
পুংরা যে সমাজে প্রতিদিন বধূহত্যা করছে, বধূনির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে, গণধর্ষণ করছে, কন্যাশিশু হত্যা করছে, সেই সমাজে আড়ম্বর করে মেয়েরাই পুংপুজো করছে। পুংপুজোর দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি। পুংদের বোধোদয় কি আদৌ ঘটবে কোনো দিন? পুংআধিপত্যবাদের কৌশল শিখে বেড়ে ওঠা পুরুষেরা কি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবে যা শিখছে সব? ঝেড়ে না ফেললে সমানাধিকারের শিক্ষাটা গ্রহণ করায় যে খুব মুশকিল হবে?
সমানাধিকারের কোনো চর্চাই নেই নারী পুরুষের সম্পর্কে। পুরুষ মনে করে তার পুরুষত্ব খানিকটা খসে গেলে বুঝি অপমান হবে তার, নারী মনে করছে তার নারীত্ব কিছুটা কমে গেলে রক্ষে নেই। এক একজন প্রাণপণে বজায় রাখতে চায় পুরুষ আর নারীর জন্য সমাজের বানানো কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পুরুষত্ব, আর নারীত্ব। যদি ধরেই নিই পুরুষের ভেতর তথাকথিত এই পুরুষত্ব আর নারীর ভেতরে তথাকথিত এই নারীত্ব আছে, তারপরও কিন্তু নিশ্চয় করে বলা যায় যে পুরুষের ভেতরে যা আছে তার একশ ভাগই পুরুষত্ব, নারীর ভেতরে যা আছে তার একশ ভাগই নারীত্ব- এ সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সমাজ চোখরাঙায় বলে পুরুষ প্রকাশ করতে চাইছে না তার ভেতরে যেটুকু নারীত্ব আছে সেটুকু। নারীকে প্রকাশ করতে বাধা দেওয়া হয় তার ভেতরের পুরুষত্বটুকু। যদি সমাজের বাধা না থাকতো, যদি সত্যি সত্যি খুলে মেলে ধরতে পারতো নিজেদের সত্যিকার চরিত্র, তাহলে সমতা আসতো সম্পর্কে। পুরুষও কষ্ট পেলে হু হু করে কাঁদতো, শিশু পালন করতো, ভালোবাসার মানুষকে রেঁধে খাওয়াতো, তার শাড়ি কাপড় কেচে ইস্ত্রি করে রাখতো। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যে মাথার ওপর বসে খবরদারি করছে। পুরুষকে শুধু নৃশংসতা করে যেতে হবে, নারীকে শুধু সর্বংসহার মতো সয়ে যেতে হবে! যতই যা হোক, নারী কিন্তু প্রমাণ করেছে পুরুষ যা পারে নারীও তা পারে। নারী পুরুষের মতোই পোশাক পরতে পারে, পুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে পারে, পুরুষের মতোই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারে, মহাশূন্যে পাড়ি দিতে পারে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে বাণিজ্য করতে যেতে পারে। পুরুষ কিন্তু আজও প্রমাণ করতে পারছে না নারী যা পারে, তা পুরুষও পারে। ঘরদোর সাফ করা, সংসারের রান্নাবান্না করা, খাবার পরিবেশন করা, শিশুর লালন পালন এখনো করছে না পুরুষেরা। যতদিন না করবে, ততদিন এ কথা বলার উপায় নেই যে সংসারে বৈষম্য নেই।
যতদিন সমাজে পুরুষতন্ত্র টিকে আছে, ততদিন এই সমাজ কাউকে সমতার আর সমানাধিকারের দিকে হাত বাড়াতে দেবে না। বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বৈষম্য ঘোচাতে হলে যেমন স্তরতন্ত্রটাকেই নির্মূল করতে হয়, নারী ও পুরুষের বৈষম্য ঘোচাতে হলে পুরুষতন্ত্রকেও নির্মূল করা প্রয়োজন। ‘পণপ্রথা বন্ধ করো’, ‘ধর্ষণ বন্ধ করো’, ‘বধূ নির্যাতন বন্ধ করো’ বলে বলে সারাবছর চেঁচালেও এসব উপসর্গ কখনো উবে যাবে না। যতদিন রোগটা আছে, উসর্গগুলো ঘাপটি মেরে থেকেই যাবে। রোগটা সারাতে হবে।” সূত্র:বাংলাদেশ প্রতিদিন।
“সতীদাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু নারীবিরোধী অনেক প্রথাই বেশ বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে এই ভারতীয় উপমহাদেশে। এসব দূর করার কোনো উদ্যোগ তো নেওয়া হচ্ছেই না, বরং আরও ঘটা করে পালন করার ব্যবস্থা হচ্ছে, আরও জাঁকালো উৎসব হচ্ছে এসবের। কিছুদিন আগেই বাঙালি বিবাহিত হিন্দু মেয়েদের ‘সিঁদুর খেলা’ হলো। দুর্গা-প্রতিমা বিসর্জনের দিন পরস্পরের মাথায় মুখে গালে কপালে চিবুকে নাকে কানে সিঁদুর মাখামাখি চলল। এই উৎসবটা মূলত- ‘স্বামী দীর্ঘজীবী হোক, অনন্তকাল বেঁচে থাকুক, স্বামীর অসুখ-বিসুখ না হোক, দুর্ঘটনা না ঘটুক, স্বামী সুস্থ থাকুক, কস্মিনকালেও না মরুক, আমাদের যা-ইচ্ছে-তাই হোক, আমাদের সুস্থতা গোল্লায় যাক, আমাদের দীর্ঘজীবনের বারোটা বাজুক’ এর উৎসব। বিধবা আর অবিবাহিতদের জন্য সিঁদুর খেলা বারণ। বারণ, কারণ তাদের স্বামী নেই। মাথায় তাদের সিঁদুর ওঠেনি অথবা সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে।
দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিয়ে করার পর একজনের শরীরে শাঁখা সিঁদুর পলা লোহার উপদ্রব চাপানো হয়, আরেকজনের শরীর আক্ষরিক অর্থে রয়ে যায় ঠিক যেমন ছিল তেমন। কেউ কি এই প্রশ্নটি করে যে, যে কারণে বিবাহিত মেয়েরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে, সেই একই কারণে কেন বিবাহিত পুরুষেরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে না? অথবা যে কারণে বিবাহিত পুরুষেরা শাঁখা সিঁদুর পলা লোহা পরছে না, সেই একই কারণে কেন বিবাহিত মেয়েরা ওসব পরা থেকে বিরত থাকছে না?
সাফ কথা হলো, পুরুষ বিশ্বাস করে এবং নারীকেও করতে বাধ্য করে যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি, মানুষ প্রজাতির মধ্যে পুরুষ নামক যে প্রাণীটি আছে, তার উরুসন্ধিতে দুই বা তিন ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের যে লিঙ্গটি ঝুলে থাকে, সেটি। সেটি যাদের আছে, তাদের গায়ে কোনো উপদ্রব চাপাতে হয় না! তাদের জীবন-সঙ্গী বা স্ত্রীটির সুস্থ থাকার জন্য, তার পরমায়ুর জন্য কোনো ব্রত পালন করতে হয় না, তার ধনদৌলত লাভের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করার কোনো আচার অনুষ্ঠান করতে হয় না, স্ত্রীর মঙ্গলকামনায় তাদের দিনভর উপোস করতে হয় না, সিঁদুর খেলতে হয় না, যেমন স্ত্রীদের খেলতে হয় স্বামীর মঙ্গলকামনায়! পুরুষেরা বরং বেশ জমিয়ে নারীকুলের পুংলিঙ্গ পুজো দূর থেকে উপভোগ করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যে যে পুজোটি চলে, সে পুংলিঙ্গ পুজো। পুরুষেরা সমাজের ঈশ্বর, সমাজের মহাশক্তিমান, মহাক্ষমতাবান, পুরুষেরা নারীর প্রভু, অভিভাবক, অধীশ্বর, নারীর কর্তা, দেবতা। পুরুষের আরও শক্তি, আরও ক্ষমতা, আরও প্রভাব, প্রতাপ এবং প্রাচুর্য বৃদ্ধির জন্য, পুরুষের দীর্ঘজীবন এবং অমরত্বের জন্য, নারীদের, দুর্বলদের, দুর্ভাগাদের, দলিতদের, র্যাতিত, নিপীড়িতদের উপোস করতে হয়, প্রার্থনা করতে হয় ভগবানের কাছে। পুরুষের মঙ্গলকামনায়, সুখকামনায়, স্বাস্থ্যকামনায় ভাইফোঁটা, শিবরাত্রি, রাখি, শ্রাবণ সোমবার কত কিছুই না সারা বছর পালন করছে নারীরা!
নারী শিক্ষিত হচ্ছে, এমন কী স্বনির্ভর হচ্ছে, স্বামীর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা অনেকের প্রায় নেই বললেই চলে, স্বামী ছাড়া চলবে না- এমন কোনো ব্যাপারই নেই, এমন নারীও পুরুষতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাগুলো দিব্যি মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে। কেউ প্রশ্ন করছে না, বিয়ের পর কেন নারীর পদবি পাল্টাতে হবে, কেন পুরুষের পদবি নয়? কেন নারীকে তার শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে হবে, কেন স্ত্রীর মতো পুরুষের কর্তব্য নয়, শ্বশুরবাড়িতে বাস করা আর শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা? পণের নিয়ম যদি পালন করতেই হয়, তবে শুধু স্ত্রী কেন স্বামীকে দেয়, স্বামী কেন স্ত্রীকে পণ দেয় না? যার আছে, তারই শুধু চাই চাই! গোটা সমাজ তাকেই ঢেলে দিচ্ছে, তাকেই ভরে দিচ্ছে, যার অনেক আছে। অত্যাচারীকে করছে আরও দ্বিগুণ অত্যাচারী। ছলে বলে কৌশলে মেয়েদের দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা, তার ওপর ধরে বেঁধে যোগ করা হয়েছে শারীরিক আর মানসিক পরনির্ভরতা। ভারতবর্ষের বেশ কিছু রাজ্যের বিবাহিত মেয়েরা ‘করভা চৌথ’ পালন করে। সূর্যোদয় থেকে চন্দ্রোদয় অবধি স্বামীর সুস্বাস্থ্যের জন্য উপোস। চাঁদ দেখবে তবে জলস্পর্শ করবে লক্ষ লক্ষ পতিব্রতা স্ত্রী। এটিও ওই পুংপুজো। এইসব আচার অনুষ্ঠানের একটিই সারকথা, সংসারে স্ত্রীর নয়, স্বামীর জীবনটি মূল্যবান। দরিদ্র-অশিক্ষিত-পরনির্ভর মেয়েরা নয়, পুরুষতান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠানগুলো বেশির ভাগই পালন করছে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়েরা। এই মেয়েরাই কিন্তু আজকাল ধর্ষণ এবং অন্যান্য নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে খুব সরব, কিন্তু সিঁদুর খেলা বা করভা চৌথ পালন করছে রীতিমতো উৎসব করে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, করভা চৌথ, সিঁদুর খেলা সবই পুরুষতন্ত্রের নারীবিরোধী উপসর্গ। এক সময় ধর্ষণকে অপরাধ ভাবা হতো না, ইদানীং ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে ধর্ষণকে ভয়াবহ অপরাধ বলে ভাবা হয়। যদি করভা চৌথ এর বিরুদ্ধে মিডিয়া মুখর হয়, মানুষ পথে নামতে থাকে, করভা চৌথকেও বড্ড অন্যায় কাজ বলে ভেবে নেবে বেশির ভাগ মানুষ।
নারীবিরোধী এসব অনুষ্ঠান নিয়ে আজকাল তুমুল বাণিজ্যও হচ্ছে। করভা চৌথের চোখ ধাঁধানো উৎসব এখন সিনেমায়, থিয়েটারে, টিভি সিরিয়ালে। বিজ্ঞাপনে পুরুষতান্ত্রিক আচারাদিতে অলঙ্কৃত লাস্যময়ী নারীদের ঝলমলে দৃশ্য। যে মেয়েরা দূর থেকে দেখে এসব, দুঃখ-দুর্দশার জীবন যাদের, তাদের ইচ্ছে হয় সাজগোজ করা ফর্সা ফর্সা সুখী সুখী মেয়েদের মতো উৎসব করতে। তারাও এক সময় বাণিজ্যের ফাঁদে পা দেয়, শাড়ি গয়না কেনার ফাঁদে। এমনিতেই এই সমাজ মেয়েদের পণ্য বলে ভাবে। পুংপুজোর আচারে অংশ নিয়ে মেয়েরা নিজেদের আরও বড় পণ্য করে তোলে। এসব করে যত বেশি পুরুষকে মূল্যবান করে মেয়েরা, ততবেশি নিজেদের মূল্যহীন করে। পুরুষতান্ত্রিক অসভ্যতাকে, অসাম্যকে, লিঙ্গবৈষম্যকে, নারীবিরোধিতাকে, নারীবিদ্বেষকে, নোংরামোকে কেবল সহনীয় নয়, আদরণীয় আর আকর্ষণীয় করার পাঁয়তারা চলছে চারদিকে। যেসব রাজ্যে করভা চৌথ পালন হতো না, এখন সেসব রাজ্যেও পালন হয়। পুরুষতন্ত্র বড্ড সংক্রামক। মানুষ সামনে এগোয়। সভ্য হয়। বৈষম্য ঘোচায়। সমাজ বদলায়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েরা যত শিক্ষিত হয়, যত নিজের পায়ে দাঁড়ায়, ততই যেন পিতৃতন্ত্রকে মাথায় তুলে নাচে, ততই ধর্মের ঢোল বাজায়। ওপরে ওপরে মনে হয় সমাজ বদলেছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হাজার বছরের পুরনো সমাজ তার পচা গলা শরীর নিয়ে অন্ধকারে ঠাঁই বসে আছে, তাকে নাড়ায় সাধ্য কার!
এই সমাজ নারীকে নানাভাবে উৎসাহিত করে পুরুষতন্ত্রের শিকার হতে। পুরুষের অধীনতা মেনে নিলে সমাজ নারীকে বাহবা দেয়। নিজের অধীনে নয়, নারী যেন কোনো না কোনো পুরুষের অধীনে থাকে। নারীর অধীনতাকে বা পরাধীনতাকে ‘নারীর গুণ’ হিসেবে ধরা হয়। গুণবতী নারী হওয়ার এই পুরস্কারটি যার জোটে, সমাজ তার ওপর খুব খুশি থাকে। সমাজকে খুশি করতে মেয়েরা যে করেই হোক চায়। কারণ একে অখুশি রেখে বা অসন্তুষ্ট রেখে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। হায়ারার্কি বা স্তরতন্ত্র কিন্তু গড়ে উঠেছে পেট্রিয়ার্কি বা পিতৃতন্ত্রের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই। স্তরতন্ত্রের মধ্যে থেকে বা স্তরতন্ত্রে বিশ্বাস করে, অধীনতা এবং আধিপত্যের অবসান ঘটানো, অথবা ক্ষমতার উঁচু নিচু স্তরকে ভেঙে সমান করে দেওয়া সম্ভব নয়। সমান করা সম্ভব করতে হলে স্তরতন্ত্রটাকেই আগে বাতিল করতে হয়। ঠিক একই রকম, নারী পুরুষের সমতাও পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তি না হলে কখনো সম্ভব নয়।
পুংরা যে সমাজে প্রতিদিন বধূহত্যা করছে, বধূনির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে, গণধর্ষণ করছে, কন্যাশিশু হত্যা করছে, সেই সমাজে আড়ম্বর করে মেয়েরাই পুংপুজো করছে। পুংপুজোর দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি। পুংদের বোধোদয় কি আদৌ ঘটবে কোনো দিন? পুংআধিপত্যবাদের কৌশল শিখে বেড়ে ওঠা পুরুষেরা কি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবে যা শিখছে সব? ঝেড়ে না ফেললে সমানাধিকারের শিক্ষাটা গ্রহণ করায় যে খুব মুশকিল হবে?
সমানাধিকারের কোনো চর্চাই নেই নারী পুরুষের সম্পর্কে। পুরুষ মনে করে তার পুরুষত্ব খানিকটা খসে গেলে বুঝি অপমান হবে তার, নারী মনে করছে তার নারীত্ব কিছুটা কমে গেলে রক্ষে নেই। এক একজন প্রাণপণে বজায় রাখতে চায় পুরুষ আর নারীর জন্য সমাজের বানানো কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পুরুষত্ব, আর নারীত্ব। যদি ধরেই নিই পুরুষের ভেতর তথাকথিত এই পুরুষত্ব আর নারীর ভেতরে তথাকথিত এই নারীত্ব আছে, তারপরও কিন্তু নিশ্চয় করে বলা যায় যে পুরুষের ভেতরে যা আছে তার একশ ভাগই পুরুষত্ব, নারীর ভেতরে যা আছে তার একশ ভাগই নারীত্ব- এ সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সমাজ চোখরাঙায় বলে পুরুষ প্রকাশ করতে চাইছে না তার ভেতরে যেটুকু নারীত্ব আছে সেটুকু। নারীকে প্রকাশ করতে বাধা দেওয়া হয় তার ভেতরের পুরুষত্বটুকু। যদি সমাজের বাধা না থাকতো, যদি সত্যি সত্যি খুলে মেলে ধরতে পারতো নিজেদের সত্যিকার চরিত্র, তাহলে সমতা আসতো সম্পর্কে। পুরুষও কষ্ট পেলে হু হু করে কাঁদতো, শিশু পালন করতো, ভালোবাসার মানুষকে রেঁধে খাওয়াতো, তার শাড়ি কাপড় কেচে ইস্ত্রি করে রাখতো। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যে মাথার ওপর বসে খবরদারি করছে। পুরুষকে শুধু নৃশংসতা করে যেতে হবে, নারীকে শুধু সর্বংসহার মতো সয়ে যেতে হবে! যতই যা হোক, নারী কিন্তু প্রমাণ করেছে পুরুষ যা পারে নারীও তা পারে। নারী পুরুষের মতোই পোশাক পরতে পারে, পুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে পারে, পুরুষের মতোই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারে, মহাশূন্যে পাড়ি দিতে পারে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে বাণিজ্য করতে যেতে পারে। পুরুষ কিন্তু আজও প্রমাণ করতে পারছে না নারী যা পারে, তা পুরুষও পারে। ঘরদোর সাফ করা, সংসারের রান্নাবান্না করা, খাবার পরিবেশন করা, শিশুর লালন পালন এখনো করছে না পুরুষেরা। যতদিন না করবে, ততদিন এ কথা বলার উপায় নেই যে সংসারে বৈষম্য নেই।
যতদিন সমাজে পুরুষতন্ত্র টিকে আছে, ততদিন এই সমাজ কাউকে সমতার আর সমানাধিকারের দিকে হাত বাড়াতে দেবে না। বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বৈষম্য ঘোচাতে হলে যেমন স্তরতন্ত্রটাকেই নির্মূল করতে হয়, নারী ও পুরুষের বৈষম্য ঘোচাতে হলে পুরুষতন্ত্রকেও নির্মূল করা প্রয়োজন। ‘পণপ্রথা বন্ধ করো’, ‘ধর্ষণ বন্ধ করো’, ‘বধূ নির্যাতন বন্ধ করো’ বলে বলে সারাবছর চেঁচালেও এসব উপসর্গ কখনো উবে যাবে না। যতদিন রোগটা আছে, উসর্গগুলো ঘাপটি মেরে থেকেই যাবে। রোগটা সারাতে হবে।” সূত্র:বাংলাদেশ প্রতিদিন।
Tidak ada komentar: পুরুষের লিঙ্গটি যেন মহামূল্যবান: তসলিমা
Posting Komentar